নিজস্ব প্রতিবেদক | শুক্রবার, ২১ নভেম্বর ২০২৫ | 21 বার পঠিত | প্রিন্ট
নিজস্ব প্রতিবেদক: বড় ধরনের ঋণ জালিয়াতি ও ব্যাপক আমানত প্রত্যাহারের সংকট কাটিয়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত তিন বেসরকারি ব্যাংক—ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), আইএফআইসি ব্যাংক এবং ইসলামী ব্যাংক—পুনরায় শক্ত অবস্থানে ফিরতে শুরু করেছে। দীর্ঘ এক বছরের অস্থিরতার পর ২০২৫ সালের প্রথম ১০ মাসে তিন ব্যাংকই উল্লেখযোগ্য হারে দুই অংকের আমানত প্রবৃদ্ধি অর্জন করায় খাতটিতে নতুন করে আস্থার সঞ্চার হয়েছে।
যদিও দেশের মোট ব্যাংক আমানতের প্রায় ১৫ শতাংশ ধারণকারী এ তিন ব্যাংকে আমানত বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তবে গভীর মূলধন ঘাটতি এখন নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। মূলধনস্বল্পতার কারণে তারা নতুন আমানত থেকে আয় করতে পারছে না এবং ব্যবসা সম্প্রসারণ কার্যক্রমও কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তিন ব্যাংকের আগের বোর্ড বাতিল করে বড় ধরনের পুনর্গঠন নেয়। ইউসিবি মুক্ত হয় সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের প্রভাব থেকে; ইসলামী ব্যাংক সরে আসে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ থেকে; আর আইএফআইসি মুক্ত হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের কর্তৃত্ব থেকে। নতুন বোর্ড গঠনের পর ব্যাংকগুলো রাইট শেয়ার, সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড এবং কৌশলগত বিনিয়োগকারী আনার মাধ্যমে মূলধন পুনর্গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সীমিত পরিসরে কার্যক্রম চালাতে ফরবিয়রেন্স দিয়েছে, প্রভিশন ঘাটতি এখনো পূরণ হয়নি। নতুন শেয়ার বা বন্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমোদন এখন ব্যাংকগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ এ (রুমি) আলী মনে করেন, পুঁজিবাজারের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহই দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে কার্যকর সমাধান। তবে নতুন শেয়ার ইস্যুর ফলে মালিকানা কমে যাওয়ার শঙ্কায় কিছু পরিচালক আপত্তি তুলতে পারেন। তার মতে, ব্যতিক্রমী এই পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতকে টিকিয়ে রাখতে বিএসইসির কিছু কঠোর নিয়ম শিথিল করা প্রয়োজন। যদিও উচ্চ অনাদায়ী ঋণ (এনপিএল) ও দুর্বল মূলধনের কারণে কয়েকটি ব্যাংকের নতুন শেয়ার ইস্যুতে এখনও নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। এমনকি বেশ কয়েকজন ব্যাংকার জানিয়েছেন—বহুবার চেষ্টার পরও তারা বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সঙ্গে বৈঠকের সময় নির্ধারণ করতে পারেননি।
ইউসিবি: খুচরা গ্রাহকদের আস্থায় ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত
ইউসিবির ক্ষেত্রে জানুয়ারি–সেপ্টেম্বর সময়কালে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি নেট আমানত যোগ হওয়ায় তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এ সময়ে মোট আমানত বেড়ে দাঁড়ায় ৬৩ হাজার কোটি টাকা—যার মধ্যে ৫৬ শতাংশ এসেছে সাধারণ খুচরা গ্রাহকদের কাছ থেকে। ব্যাংকটি সিআরআর, এসএলআর ও এডিআর মানলেও মূলধন ঘাটতি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে সিআরএআর দাঁড়ায় ৭.৬৯ শতাংশে, যা ন্যূনতম ১০ শতাংশের চেয়ে কম।
এই ঘাটতি পূরণের জন্য তারা পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশ সমমূল্যের শেয়ার কৌশলগত বিনিয়োগকারীর কাছে ইস্যুর ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি ৭৭৫ কোটি টাকার রাইট শেয়ার ও ৮০০ কোটি টাকার সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যুর প্রস্তাব করেছে, যা কমপ্লায়েন্স জটিলতায় চার মাস ধরে বিএসইসিতে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ইউসিবির এমডি মনে করেন, পূর্বের বোর্ডের দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণের বোঝা রাতারাতি কাটানো সম্ভব নয় এবং এই পরিস্থিতিতে কৌশলগত বিনিয়োগকারী সংগ্রহ অত্যন্ত জরুরি।
ইসলামী ব্যাংক: আমানত ও রেমিট্যান্সে পুরনো অবস্থানে ফেরা
ইসলামী ব্যাংকও ঘুরে দাঁড়ানোর চমকপ্রদ অগ্রগতি দেখিয়েছে। এস আলম গ্রুপ–সংশ্লিষ্ট কেলেঙ্কারির পর ব্যাপক আমানত উত্তোলন হলেও ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে ব্যাংকটির আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। এই সময়ে নেট আমানত বেড়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা, যা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। রেমিট্যান্স প্রবাহও আবার শীর্ষ স্থানে ফিরেছে।
তবে দীর্ঘদিন গোপনে চাপা থাকা খেলাপি ঋণের বোঝায় ব্যাংকটির সিআরএআর নেমে এসেছে মাত্র ৭ শতাংশে। পাশাপাশি রয়েছে ৮৬ হাজার কোটি টাকার বিশাল প্রভিশন ঘাটতি। মূলধন সংগ্রহ পরিকল্পনা এখনো হাতে নেওয়া হয়নি—কারণ এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ৮২ শতাংশ শেয়ার বাংলাদেশ ব্যাংক জব্দ করেছে এবং আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এসব শেয়ার লিকুইডেশনের পর নতুন কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
আইএফআইসি ব্যাংক: সংকট কাটিয়ে নতুন আমানত বৃদ্ধির ধারা
আইএফআইসি ব্যাংকও গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার ধাক্কা কাটিয়ে পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অগাস্টের তিন মাসে ৫ হাজার কোটি টাকা আমানত হারালেও এক বছর পর তারা ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি নতুন আমানত সংগ্রহে সক্ষম হয়েছে। বোর্ড পরিবর্তনের পর ব্যাংকটি আবারও ঋণ বিতরণ শুরু করেছে।
তবে ১৭ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি এবং দুর্বল মূলধনের কারণে ব্যবসা সম্প্রসারণ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ব্যাংকের এমডি জানান, তাদের ৩০ শতাংশের বেশি শেয়ার সরকারের মালিকানায় থাকায় সরকারি সহায়তায় মূলধন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। পাশাপাশি এসএমই ব্যাংকিং সম্প্রসারণ ও বিস্তৃত উপশাখা নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
Posted ৯:২৫ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ২১ নভেম্বর ২০২৫
sharebazar24 | sbazaradmin
.
.